সাকিব যেভাবে বিশ্বকাপের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছেন

ক্রিকেট কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন কি জ্যোতিষী হয়ে গেলেন! সেরা হওয়ার জন্যই বিশ্বকাপে যাচ্ছেন সাকিব—বিশ্বকাপ শুরুর আগে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন সাকিবের গুরু হিসেবে পরিচিত কোচ সালাউদ্দিন। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের সামর্থ্য নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। তাই বলে ইংল্যান্ডের মাটিতে বিশ্বকাপের সেরা হওয়া? বিশ্বকাপের শুরুতেই ভবিষ্যদ্বাণী ফলতে শুরু করে মাঝামাঝিতে এসে মিলে যাওয়ার পথে। এই আলোচনা এখন শুরু হয়ে গেছে—সাকিবই এই বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়।

সাকিব-সালাউদ্দিনের সম্পর্কটা নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) ছাত্র ছিলেন আজকের বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব। সালাউদ্দিনও ছিলেন সেখানকারই কোচ। সেখানে সালাউদ্দিনের যত্নশীল ঝিনুকে লালিত মুক্তা হয়ে সাকিবের গড়ে ওঠা। শচীন টেন্ডুলকার আর রমাকান্ত আচরেকারের সম্পর্ক যেমন, সাকিব-সালাউদ্দিনের রসায়ন অনেকটা একই রকম। যত বড় কোচের অধীনেই সাকিব থাকুন না কেন, সালাউদ্দিনের সঙ্গে তাঁর দেখা করা চাইই। সেটা খারাপ সময় হোক কিংবা ফর্মের উত্তুঙ্গু অবস্থাতেই হোক। সাকিবের যেন প্রিয় ‘স্যার’কে ছাড়া চলেই না!

এবারের ২০১৯ বিশ্বকাপে খেলতে যাওয়ার আগে প্রিয় কোচকে ভারতে ডেকে নিয়ে বিশেষ প্রস্তুতি নিয়েছেন সাকিব। আইপিএলে সানরাইজার্স হায়দরাবাদের হয়ে খেলার সুযোগ পাচ্ছিলেন না। কিন্তু বিশ্বকাপের আগে মুম্বাই-হায়দরাবাদে কেনা কেটা করে বা ঘুরে বেড়িয়ে সময় কাটাতে চাননি। আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজির অনুশীলনের মধ্যেই প্রিয় কোচের কাছে আলাদা করে ঝালিয়ে নিয়েছেন নিজেকে। এর আগেও দুই জনের বিশেষ প্রস্তুতি হয়েছে বহুবার। তবে এবারের প্রস্তুতি নিয়ে উভয়েই ছিলেন পুরোপুরি সন্তুষ্ট।

আগের প্রস্তুতির সঙ্গে এবারের প্রস্তুতির পার্থক্য ফিটনেস ও টেকনিক নিয়ে অধিক পরিশ্রম। যার ফলেই শিষ্যকে নিয়ে বাজি ধরেছিলেন সালাউদ্দিন, ‘বিশ্বকাপের আগে অন্যদিকে তাকানোর সুযোগ ছিল না। বিশ্বকাপ চলে এসেছে, আর সেখানে ও নিজেকে আলাদা করেই চেনাতে চায়, সেরা হতে চায়। সেটা হতে হলে খেলায় কোথায় কোথায় উন্নতি করা দরকার, সেটাও খুব ভালোমতো জানে ও। পরিশ্রমের মানদণ্ডে হয়তো ও সবার ওপরে কখনোই আসবে না। কিন্তু ও নিজের পারফরম্যান্স নিয়ে খুবই খুঁতখুঁতে। কখন কতটা পরিশ্রম করতে হবে, এ নিয়ে ওর নিজস্ব একটা ফর্মুলা আছে। আমাকে হায়দরাবাদে ডাকার কারণটাও এটাই। ওর মনে হচ্ছিল, ব্যাটিং-বোলিংয়ে কিছু বিষয় নিয়ে কাজ করা দরকার। আমাকে নিয়ে ও সেটাই করল। যা থেকে বুঝলাম, বিশ্বকাপটা তার মাথায় ঘুরছে। সেখানে ও সব সময়ের মতোই নিজেকে চেনাতে চায়।’

ইংল্যান্ডের কন্ডিশন অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে আলাদা। জানা কথাই। খেলতে হবে পেস বোলারদের বিপক্ষে বাউন্সি উইকেটে। ভারতের প্রস্তুতি পর্বটা সেভাবেই সাজানো ছিল বলে জানান মোহাম্মদ সালাউদ্দিন, ‘আমরা যখন ভারতে ছিলাম, তার পুরো মনোযোগ ছিল বিশ্বকাপে। বিশ্বকাপে কোন ধরনের বল খেলতে হবে, এ জন্য প্রচুর শর্ট বল খেলার অনুশীলন হয়েছে সেখানে। এ ছাড়া ইংলিশ কন্ডিশনে কীভাবে স্পিন সামলাতে হবে, তা নিয়েও হয়েছে বিশেষ অনুশীলন।’ অনুশীলন কাজে লেগেছে। তাই কার্ডিফে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরির পর সাকিব বার্তা পাঠিয়েছিলেন ‘থ্যাংক ইউ স্যার।’

বিশ্ব ক্রিকেটে নিজেকে নতুন করে প্রমাণ করার কিছু নেই সাকিবের। পরিসংখ্যানের বিচারে নিজের সময়ের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার সাকিব, সে বিষয়ে সন্দেহ ছিল না কখনোই। কিন্তু কিংবদন্তি হতে হলে বিশ্বকাপের মত বড় মঞ্চে সব আলো কেড়ে নিতে হয়। এই কাজটি এবার খুব ভালো ভাবে করে দেখাচ্ছেন ‘বাংলাদেশের প্রাণ’। প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৭৫, দ্বিতীয় ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৬৪, তৃতীয় ম্যাচে কার্ডিফে অনবদ্য ১২১। এর পরে তো চতুর্থ ম্যাচে রানের প্রতি রুচি ওঠে যাওয়ার কথা। কিন্তু টন্টনে সাকিবকে দেখা গেল আরও ক্ষুধার্ত। তাঁর অপরাজিত ১২৪ রানের মহাকাব্যিক ইনিংসের ওপর ভর করে রান (৩২২) তাড়া করার রেকর্ড গড়ে জয় তুলে নিয়েছে বাংলাদেশ। আর সব মিলিয়ে ৩৮৪ রান করে সর্বোচ্চ রানের মালিক এখন সাকিব।

চার ম্যাচ শেষে সাকিব নিয়ে যতই বলা হবে, কম হয়ে যেতে পারে! তবে সালাউদ্দিনের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী সামনে আরও অনেক বেশি দেওয়ার আছে তাঁর শিষ্যের, ‘সাকিব নিজের খেলা, নিজের লক্ষ্য সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন। এবার বিশ্বকাপে ওর ভূমিকাটা কী হওয়া উচিত, সেটাও ওর মাথায় সাজানো আছে। আমার চাওয়া ওর কাছে, ও যেন নিজের নামের প্রতি সুবিচার করে খেলে। ও কত রান করল, সেঞ্চুরি করল কি না, উইকেট পেল কয়টা—সেই হিসাবে আমি যেতে চাই না। আমি চাই, একজন ক্রিকেটার হিসেবে বিশ্বে ওর যে সম্মানটা আছে, সেটা যেন বিশ্বকাপেও বজায় থাকে। বিশ্বকাপের সেরা পারফরমার হিসেবে যেন আমি ওকে দেখতে পাই।’

বিশ্বকাপের মাঝামাঝি পর্যন্ত সালাউদ্দিনের ভবিষ্যদ্বাণী মিলে যাচ্ছে। বাকিটা পথ মিলে গেলে বাংলাদেশকে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে দেখা যেতেই পারে। আর হ্যাঁ সাকিব তো সেরার দৌড়ে থাকছেনই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *